তালেবানরা যদি মানবিকভাবে রাষ্ট্র চালাতে পারে, মানবতার মূল্যবোধ তুলে ধরতে পারে তাহলে হয়তো তারা হারানো মুসলমান জনতা হতে পারে যার জন্য কবি নজরুল বলে গিয়েছিলেন কোথা সে মুসলমানǃ তালিবানরা যদি মানবিক হয় তাহলে তারা এমন হতে পারে যেমন খলিফায়ে রাশেদীনের যুগে মুসলমানরা যেমন ছিলেন যে রাতের আঁধারে প্রজাদের সুখ দুঃখ দেখার জন্য উমর রা: শহরের অলি গলি ঘুরে বেড়াতেন, অভূক্ত শিশুর জন্য তার মায়ের কাছে নিজ পিঠে করে ময়দার বস্তা পৌঁছে দিতেন। এখন সময়ই বলে দিবে তালেবানরা বিগত বারের মতো যথেচ্ছাচারী ও বর্বর হবে নাকি এখন নারী অধিকারসহ যে নানান প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তা বাস্তবায়ন করে ইসলামিক আদর্শ, মূল্যবোধের, নীতি ও সংকৃতির সর্বোচ্চ চর্চা করে হারানো সে মুসলমান হবে।
সারা বিশ্বে যুগের পর যুগ মুলিমরা শুধু গ্লানিতেই ভুগছিলো, হীনমন্যতায়, ও এক ধরণের আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগছিল। কারণ মুসলিমরা শেষ খলিফা সুলতান আব্দুল হামিদের পর থেকে আর তাৎপর্যপূর্ণ জয়ের সাধ পায়নি। সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, বৈজ্ঞানিক সব ক্ষেত্রেই পশ্চাদমুখী হতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে খেলাফত ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়ার মতো কোনো মুসলিম শক্তি ছিলোনা। এরপর একমাত্র ইমাম খোমেনীর বিপ্লবের পর মুসলিমদের আর কোনো তেমন সাফল্যও আসেনি। ১৯৭৩ সালে চতুর্থ আরব ইস্রাঈল যুদ্ধে [যা আরব জাহানে রামাদান ওয়ার বা ইয়ম কিপ্পুর ওয়ার নামেও পরিচিত] মুসলিম শক্তি প্রথমে Surprise Attack পরিকল্পনায় “মারাত্মক” সাফল্য পেলেও শেষ পর্যন্ত বিনইয়ামিন পেলেদ, আভরাহাম মন্ডলে, এরিয়েল শ্যারন, শমূয়েল গোনেন এর মতো প্রতিভাধারী দক্ষ ইসরাইলী সেনানায়কদের নেতৃত্বের কাছে মাত্র ৬ দিনের ব্যবধানে বিপর্যস্ত হয়। শুধু আরব-ইস্রাঈল যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানিই নয়, মুসলিম নামধারী জঙ্গি গোষ্ঠী গুলো ইসলামের ইমেজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। বিদেশে বেড়াতে গেলে কোনো ইতালিয়ান বন্ধু বা আইরিশ বন্ধুদের কাছে কথা বলতে গেলে লজ্জা পেতে হতো । আবার কোনো ইউরোপিয়ান বা অস্ট্রেলিয়ান নতুন বন্ধুর কাছে আমি মুসলিম এ পরিচয় দিয়ে কুন্ঠা বোধ করতে হতো। অন্যদিকে বিজ্ঞান, খেলাধুলা, সংগীত, দর্শন, গবেষণা, টেকজনোলোজি এসব সেক্টরে মুসলিমরা অনেক পিছিয়ে থাকার কারণেও আমরা এক প্রকার গ্লানি ও বিষাদে ভুগতাম। তালেবানের এ বিজয় আমাদের আত্মশক্তি ও চেতনার উপর পড়ে যাওয়া কালো আস্তর সরিয়ে দিয়েছে।
Attribution: Voice of America News, Public domain, via Wikimedia Commons
গত দশকে বসনিয়া হার্জেগোভিনা থেকে শুরু করে মুসলিমরা যে মার খায় তার তুলনা শুধু নরকই হতে পারে। এমনকি বসনিয়ায় ধর্ষিতা লাখো নারীকে উদ্ধারে বিলাসবহুল সৌদি আরব এগোয়নি, সমৃদ্ধ আবুধাবি দুবাই এর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতও এগোয়নি। উদ্ধার করেছিল পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর সমন্বয়ে বহুজাতিক বাহিনী। ঘটিরাম সৌদিআরব, দুবাই, কুয়েত এসব ধনী মুসলিম রাষ্ট্র ইসলামের গৌরব, শৌর্য-বীর্যের পতাকা বহন করেনা। উসমানীয় খেলাফত ভেঙে এদের উৎপত্তি তেল করায়ত্ত করার ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্যে চক্রান্তকারী অশুভ শক্তির পা ধরে ও লেজুড় বৃত্তি করে। এরা কখনোই হারানো ইসলাম ফিরিয়ে আনতে পারেনি। পারবেওনা।
Attribution: VOA, Public domain, via Wikimedia Commons
পৃথিবী এই অত্যাধুনিক যুগে এসে দেখলো শুধুমাত্র মনোবলসমৃদ্ধ ঈমানশক্তির একটি দলের কাছে প্রবল পরাশক্তির নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনী ও সরকারি আফগান বাহিনীর সম্মিলিত পরাজয়। বিশ্ববাসী দেখলো কিভাবে সুবিধাবাদী মীরজাফর, রাজাকার ও তাঁবেদার লোকদের কাবুল এয়ারপোর্টে উড়োজাহাজের ডানায় ঝুলে ও চাকায় নিজিদের বেঁধে পালানোর দৃশ্য।
আবার অন্যদিকে দেখলো এই অত্যাধুনিক যুগের প্রিভিলেজড মিডিয়া চ্যানেলগুলো কিভাবে তালেবানদের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই অপপ্রয়চার চালিয়ে যাচ্ছিলো যার মধ্যে বাংলাদেশের কিছু তাবেদার টিভি চ্যানেলগুলোও একই কান্ড ঘটিয়েছে। তাদের এসব নির্বোধ কাণ্ডের মধ্যে বিকৃত তথ্য প্রচার, মিথ্যা খবর প্রচার, নারীদের উপর ধর্ষণের মিথ্যা আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া, ভিন্ন-মতাবলম্বীদের গণহত্যার মিথ্যা আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া যার কোনোটাই আর সত্যি পরিনত হয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্যি ভালোভাবে এনালাইসিস না করেই তারা এ কাজটি করেছে এবং আজও করে যাচ্ছে শুধুমাত্র তালেবানরা তাদের মতো সংস্কৃতি ও চিন্তা-চেতনার অধিকারী নয় বলে। অন্যদিকে সুখের বিষয় হচ্ছে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশের স্থানীয় মিডিয়াগুলো আবার তালেবানদের সম্পর্কে ভালো ও সত্য খবর প্রচার করে।
Attribution: U.S. Marine Corps photo by Staff Sgt. Victor Mancilla/U.S. Central Command Public Affairs, Public domain, via Wikimedia Commons
যেসব মিডিয়া বিকৃত ও উদ্দেশ্যমূলক ভিত্তিহীন খবর রটাচ্ছে তারা হয়তো জানেনা খোদ রাশান বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে পূর্ব বার্লিন দখলের পর এক নারকীয় পৈশাচিকতার পরিচয় দেয় লাখো জার্মান নারীকে ধর্ষণ করে। ভিক্টিম নারীদের মধ্যে জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কুহলের পত্নীও ছিলেন যিনি ফার্স্ট লেডি হয়েও পূর্বের সে পৈশাচিকতার কথা ভুলতে পারেননি এবং দীর্ঘকাল মানসিক রোগে ভুগে শেষ পর্যন্ত হতাশা ও মর্ম পীড়ায় আত্মহত্যা করেন। ইতিহাস আরো সাক্ষ্য দেয় পশ্চিম বার্লিন দখলের পর মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের দ্বারা হাজারো নারী নিপীড়ন ও নির্যাতনের কথা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত, পাহাড়ে-পর্বতে অনাহারে অর্ধাহারে ২০টি বছর সংগ্রামে থাকা তালেবান গেরিলা বাহিনী কি তাদের চেয়ে উত্তম মানুষ নয়? শুধুমাত্র ইসলামের আলোয় উজ্জলিত হবার কারণে সব অপপ্রচার ও আশংকাকে তালেবানরা নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হয়েছে।
Sayed Hasib Maududi, Roshan Noorzai (VOA), Public domain, via Wikimedia Commons
তালেবানদের এ বিজয়ে আমাদের হারিয়ে যাওয়া গৌরবের সূর্য নতুন করে পূর্ব আকাশে উঁকি দিয়েছে। আমাদের মুসলিম জাহানের উপর থেকে বিষাদের পর্দা সরে গেছে। আবির্ভুত হয়েছে প্রেরণার নতুন এক উজ্জ্বল আলোক মালা। শুরুটা যেন অ্যাক্টিভেটেড হয়ে গেছে। এখন ক্রমশ বিকাশের পালা। এটা পর্যালোচনা করা যায় যে তালেবানরা শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমন করে একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র গঠন করতে চলেছে। আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি তালেবান মুখপাত্র নারীদের শিক্ষা ও বাইরের কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমরা এও দেখেছি যে সংবাদ সম্মেলনে ও টিভি প্রোগ্রামে নারীদের অগ্রাধিকার দেবার দৃশ্য। এ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে তা বিশ্লেষণ করে প্রজেকশন করা যায় যে তালেবানরা ইসলামের এই বিরল সাফল্যকে আরো বড় পর্যায়ে নিয়ে মুসলিম জাহানের এক গৌরব গাঁথা রচনা করবে।